চার দশকের বন্ধ দরজা খুলছে ,বড়াল নদীতে ফিরে আসছে প্রাণের সম্ভাবনা !
![]() |
স্লুইসগেটের কপাট খোলার কাজ শুরু হয়েছে |
চার দশক ধরে কেবল নীরবতা বইছে যে নদীর বুকে, সেই বড়াল যেন এবার ধীরে ধীরে শব্দ তুলছে। তবে সে শব্দ এখনো প্রবল স্রোতের নয় বরং এটি একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস, যে নিঃশ্বাসে আছে নতুন করে বাঁচার আকুতি। রাজশাহীর চারঘাটে অবশেষে বড়াল নদীর মুখে থাকা স্লুইসগেটের কপাট খোলার কাজ শুরু হয়েছে। ৪০ বছর ধরে বন্ধ থাকা এই কপাট খুলে দেওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হলো বড়ালকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রক্রিয়া। |
নদী যে শুধু পানি নয়, সে মানুষের ইতিহাস, সংস্কৃতি, জীবনের অংশ। অথচ চারঘাটের মানুষদের জীবনে বড়াল বহু বছর ধরেই এক মৃতপ্রায় স্মৃতি। ১৯৮৪ সালে পদ্মা নদীর ভয়াবহ বন্যার সময় চারঘাট ও আশপাশের অঞ্চলকে রক্ষায় বড়াল নদীর মুখে নির্মাণ করা হয় একটি স্লুইসগেট। উদ্দেশ্য ছিল, বন্যার পানি ঠেকিয়ে কৃষি ও জনপদ রক্ষা করা।
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেই স্লুইসগেট হয়ে ওঠে অভিশাপ। প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেলে নদী শুকিয়ে যায়। তার বুক ভরে উঠে পলিতে, চারপাশে শুরু হয় দখল ও দূষণ। নদীর জায়গা দখল করে গড়ে ওঠে ঘরবাড়ি, দোকান, অবৈধ স্থাপনা।
সেই সঙ্গে নদী হারায় তার প্রাণ, হারায় তার গতিপথ, আর তার বুকজুড়ে জমে ওঠে নীরবতার স্তব্ধতা।
এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় মানুষ, সমাজকর্মী ও পরিবেশবাদীরা স্লুইসগেট অপসারণের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। তবে নানা প্রশাসনিক জটিলতায় দীর্ঘদিন ধরে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হয়নি।
বছরের পর বছর নদী খননের নামে কিছু অপ্রতুল কাজ চললেও সমস্যার মূল জায়গায় হাত দেওয়া হয়নি। অবশেষে আশার আলো দেখা যায় ২০২৫ সালের ১৯ মে, যখন বড়াল নদী পরিদর্শনে আসেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
তিনি নদীর বাস্তব পরিস্থিতি দেখে ঘোষণা দেন বড়াল নদীর ১৮ কিলোমিটার পুনঃখনন করা হবে এবং মুখে থাকা স্লুইসগেট খুলে দেওয়া হবে, যেন নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ফেরানো যায়।
এই ঘোষণার পর চারঘাটে যেন একপ্রকার স্বস্তি ফিরে আসে। বছরের পর বছর ধরে যে নদীকে সবাই ধুঁকতে দেখে আসছিল, সে নদীকে নিয়ে আবার আশাবাদী হতে শুরু করে এলাকাবাসী।
ঘোষণার ঠিক কয়েক সপ্তাহ পরই, চলতি বছরের ১২ জুন থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ড স্লুইসগেটের কপাট খোলার কাজ শুরু করে। বড়াল নদীর মুখে থাকা তিনটি গেটের প্রতিটির প্রস্থ ১০ ফুট করে—মোট ৩০ ফুট। এর মধ্যে প্রাথমিকভাবে কয়েকটি গেটের কপাট খুলে দেওয়া হয়েছে।
তবে এখনো পুরোপুরি পানিপ্রবাহ শুরু হয়নি। নদী এখনও পুরো গতিতে বইছে না। শুধুই শুরু হয়েছে পথ খুলে দেওয়ার কাজ যে পথ বন্ধ ছিল চার দশক ধরে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী পার্থ সরকার বলেন ,মাননীয় উপদেষ্টার নির্দেশনার পর আমরা দ্রুত কাজ শুরু করেছি। প্রাথমিকভাবে কপাট খোলার মাধ্যমে পানিপ্রবাহ বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। এটি ধাপে ধাপে পুরো প্রকল্প বাস্তবায়নের দিকে এগোবে। আমরা আশাবাদী, বড়াল আবার জেগে উঠবে।
স্থানীয় কৃষক, জেলেসহ সাধারণ মানুষ বলছেন এখনো স্রোত আসেনি, কিন্তু কপাট তো খুলছে! এই দীর্ঘ অপেক্ষার পর এই ছোট পরিবর্তনই যেন তাদের কাছে বড় স্বস্তি। কারণ এই স্লুইসগেটের কারণেই বছরের পর বছর চাষাবাদে ব্যাঘাত ঘটেছে, জেলেরা নদীতে মাছ পায়নি, এবং আশেপাশের এলাকায় পানির সংকট বেড়েছে।
একজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন,আমরা ছোটবেলায় এই নদীতে নৌকা চালাতে দেখেছি, বড়রা মাছ ধরতেন। এখন সেখানে কাদামাটি, ঝোপঝাড়। আজ যখন শুনছি গেট খুলছে, তখন মনে হয় বড়াল আবার জেগে উঠবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল স্লুইসগেট খুললেই হবে না প্রয়োজন সঠিকভাবে এবং দীর্ঘমেয়াদে নদী খনন, তদারকি ও আইনানুগভাবে দখলমুক্ত করার ব্যবস্থা। তা না হলে এই অগ্রগতি আবার থেমে যেতে পারে।
পরিবেশবাদীদের মতে, বড়াল নদী দেশের সেইসব মৃতপ্রায় নদীর একটি উদাহরণ, যেগুলো পরিকল্পনার অভাবে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। বড়ালকে কেন্দ্র করে যদি সফল পুনরুজ্জীবনের মডেল তৈরি করা যায়, তবে তা হবে দেশের অন্যান্য নদীর ক্ষেত্রেও একটি অনুপ্রেরণা।
স্রোত এখনো বইছে না। কেবল খুলেছে বন্ধ দরজার প্রথম পাট। তবে ৪০ বছরের নীরবতা ভেঙে এই যে দরজাটা একটু ফাঁক হয়েছে, এটিই বড়ালের জীবনে নতুন সকালের ইঙ্গিত। এখন সময় শুধু ধৈর্য ও সঠিকভাবে কাজ এগিয়ে নেওয়ার।#
No comments